প্রকাশিত: ০৭/০৬/২০১৬ ৮:২০ এএম

campনিউজ ডেস্ক::

বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা আসলাম চৌধুরীর ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ কানেকশনের ভয়ংকর বিপজ্জনক খবরের আড়ালে আরেকটি উদ্বেগজনক ঘটনা নীরবে সবার চোখের আড়ালে চলে গেছে। গত ১২ মে দিবাগত রাতে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার একটি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের আনসার ব্যারাকে আক্রমণ চালিয়ে দুর্বৃত্তরা ১১টি রাইফেল ও ৬৯০ রাউন্ড গুলি লুটে নেয়। আক্রমণে নিহত হয়েছেন আনসার কমান্ডার আলী হোসেন। আহত হয়েছেন আরো কয়েকজন আনসার সদস্য। নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্পে এত বড় আক্রমণ এর আগে কখনো হয়নি। স্থানীয় রোহিঙ্গা শিবিরের সাধারণ বাসিন্দা, বন বিভাগের কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতে, উল্লিখিত আক্রমণ অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এবং এটা চালিয়েছে জঙ্গি সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্যরা। লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলা-বারুদের কোনো হদিস এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ সৃষ্টিকারী অনেক তথ্য উঠে এসেছে কালের কণ্ঠ’র ১৪ মের একটি প্রতিবেদনে।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের ১৮ হাজার একর বনভূমির মধ্যে প্রায় আট হাজার একর গহিন অরণ্য ও দুর্গম এলাকা। টেকনাফ উপজেলার এসব দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় স্থানীয় ক্ষমতাবানদের সহযোগিতায় বিভিন্ন ছদ্মনামে রোহিঙ্গা জঙ্গিরা প্রশিক্ষণকেন্দ্র তৈরি করে নিয়মিত জঙ্গি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালাচ্ছে। অভিযোগ আছে, অদৃশ্য কারণে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব বিষয়কে কখনো গুরুত্ব দেয় না, দেখেও না দেখার ভান করে। স্থানীয় সিনিয়র সাংবাদিকদের সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার শহরে সরকারি কলেজের সঙ্গে লাগোয়া বিশাল এক মাদ্রাসায় আন্তর্জাতিক অর্থায়নে রোহিঙ্গাদের জঙ্গি তত্পরতায় উদ্বুদ্ধকরণের কাজ চলে প্রকাশ্যে। রোহিঙ্গা নেতা মাওলানা ছানাউল ইসলাম এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং এখনো অধ্যক্ষ আছেন। এই একই বিষয়ের ওপর ২০১৫ সালের ১০ এপ্রিল অন্য একটি প্রধান দৈনিকে আরেকটি বড় প্রতিবেদন ছাপা হয়। কক্সবাজার উখিয়া রেঞ্জে সদর বন বিটের আওতাধীন মধুরছড়া এলাকায় প্রায় ১০ একর বনভূমি দখল করে নির্মাণ করা হয় রহস্যময় ৫০টি সেমিপাকা স্থাপনা। পত্রিকায় তখন এগুলোর ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল। ছবিতে দেখা যায় সামরিক বাহিনীর কায়দায় কৃত্রিম টার্গেট স্থাপন করে গুলি ছোড়ার প্রশিক্ষণ মাঠ অর্থাৎ ফায়ারিং রেঞ্জও সেখানে তৈরি করা হয়েছিল। জানা যায়, জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড চালাতে ভূমিহীনদের ব্যানারে জঙ্গি কাজে অর্থ প্রদানকারী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, তুরস্ক ও পাকিস্তানের অঢেল টাকায় এবং স্থানীয় ক্ষমতাবানদের প্রত্যক্ষ মদদে নির্মিত হয় ওই সব স্থাপনা। প্রথম দিকে নিশ্চুপ থেকে অ্যালার্ম বেল বাজার পর স্থানীয় প্রশাসন এগুলো ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু অভিযোগ আছে, ওই এলাকার এমপির কারণে উচ্ছেদ অভিযানের স্থানীয় উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। তবে তার কয়েক দিন পর গত বছর ৪ মে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কড়া হুকুমে ওই সব স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। দেশ-বিদেশে এটা এখন সর্বজনবিদিত যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব রকম জঙ্গিমুক্ত দেশ গড়তে বদ্ধপরিকর। মিয়ানমার ও ভারতের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়ার বিরুদ্ধে সরকারের ঘোষিত নীতি অত্যন্ত স্পষ্ট। একেবারে জিরো টলারেন্স। শুধু মুখে নয়, বাস্তবেও তার প্রতিফলন দেখা গেছে। কিন্তু কক্সবাজারের কিছু স্থানীয় প্রভাবশালী ধান্দাবাজ নেতার কারণে সরকারের নীতি মার খাচ্ছে এবং ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। জানা যায়, মাওলানা আবদুল আজিজ নামের এক ব্যক্তি, যিনি আগে জঙ্গি আস্তানা পরিচালনা করতেন, তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন (কালের কণ্ঠ, ১৪ মে)।
রোহিঙ্গা শিবির ও বসতি এলাকায় ধর্মীয় লেবাসে সন্দেহপ্রবণ দেশি-বিদেশি লোকের ব্যাপক আনাগোনা চলে সব সময়। কারা আসে, কারা যায় এর কোনো সঠিক নজরদারি আছে বলে মনে হয় না। গত বছর ঈদুল আজহার সময় তুরস্কের একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কর্মীরা রোহিঙ্গাদের ভেতরে কয়েক কোটি টাকা বিলি করে বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। একটু আগে উল্লিখিত মাওলানা আবদুল আজিজ ছিল তুরস্কের ওই এনজিওর অন্যতম সহযোগী। রোহিঙ্গা শিবির ও বসতি এলাকাগুলোকে কেন্দ্র করে দেশি-বিদেশি এনজিও এবং অন্যান্য ছদ্মবেশী তথাকথিত সাহায্যকারী সংস্থার সন্দেহপ্রবণ ও দুরভিসন্ধিমূলক কার্যকলাপের ফলে বাংলাদেশের জন্য ত্রিমুখী প্রত্যক্ষ নিরাপত্তার হুমকি সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের জেএমবি, হুজি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে রোহিঙ্গা জঙ্গিদের সখ্য ও যোগসাজশ বহুল সুবিদিত। এর চাক্ষুষ খবর বহু সময় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, গত ১২ মে আনসার ক্যাম্পে আক্রমণের সঙ্গে জেএমবির যোগসাজশ রয়েছে এবং লুট হওয়া অস্ত্রগুলোও জেএমবির হাতে চলে গেছে। তবে ঘটনার সঙ্গে জড়িত একজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করার পর জানা যায় লুণ্ঠিত অস্ত্র রোহিঙ্গা জঙ্গিরা মিয়ানমারে নিয়ে গেছে। দ্বিতীয় নিরাপত্তার হুমকির জায়গা হলো মানবতা ও ধর্মীয় ছদ্মবেশে মধ্যপ্রাচ্যসহ পাকিস্তান ও তুরস্কের অনেক উগ্রবাদী জঙ্গি নেতা অবাধে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে আসছেন ও অর্থের লোভ দেখিয়ে, ধর্মীয় আবেগ ছড়িয়ে রোহিঙ্গা যুবকদের আরএসওসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করছেন। বিদেশ থেকে আগত ছদ্মবেশধারী জঙ্গি নেতাদের মাধ্যমে বাংলাদেশি জঙ্গিরা আন্তর্জাতিক সংযোগ স্থাপন ও গোপনে অর্থ সংগ্রহের সুযোগ পাচ্ছে। আরো বিপজ্জনক খবর হলো, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই রোহিঙ্গাদের ভেতরে বাংলাদেশবিরোধী তত্পরতা চালানোর সুযোগ পাচ্ছে। গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গির জবানবন্দি অনুসারে ১২ মে দিবাগত রাতে আনসার ক্যাম্পে আক্রমণের নেতৃত্ব দেয় একজন পাকিস্তানি জঙ্গি। তৃতীয়ত, সীমান্তের ওপার থেকে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ভুল ধারণাবশত রোহিঙ্গা জঙ্গিদের উদ্দেশে কখনো কখনো এলোপাতাড়ি গোলাগুলি ছুড়ছে, যার ফলে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে প্রায়ই উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং দুই পক্ষের মধ্যে প্রত্যক্ষ গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে। গত ১১ মে রাতে মিয়ানমার থেকে নিক্ষেপ করা মর্টারের গোলা পড়েছে বান্দরবানের একটি বিজিবি ক্যাম্পে। এতে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও বিজিবি ক্যাম্পের হেলিপ্যাড আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এগুলো তো প্রত্যক্ষ নিরাপত্তার হুমকি। এগুলো ছাড়া আরো কতগুলো কারণ পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি হয় এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে এবং ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। ইয়াবার মতো ভয়ংকর মাদক মিয়ানমার থেকে আসছে বাংলাদেশে, যার প্রধান অবলম্বন, সংযোগ ও বাহক, পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের অবলম্বন করে মাদক ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়ছে কক্সবাজারের স্থানীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তারা। কক্সবাজার সীমান্তের ওপারে গড়ে উঠেছে ইয়াবা তৈরির কারখানা, যার মালিক মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। সুতরাং রোহিঙ্গাদের একটি প্রভাবশালী অংশ, বাংলাদেশের স্থানীয় ক্ষমতাবান কিছু ব্যক্তি ও মিয়ানমারের ক্ষমতাধারী উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের যোগসাজশে একটি ত্রিচক্র স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী রোহিঙ্গা ইস্যুকে পুঁজি করে নিজেদের ভাগ্য গড়ে নিচ্ছে। তাই শোনা যায়, ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত মিয়ানমারের উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা ইস্যু জিইয়ে রাখতে চান, এর সমাধান চান না। নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে এমন আরেকটি ঘটনা ঘটে যাচ্ছে ধীরগতিতে, যে দিকে কেউ লক্ষ করছে বলে মনে হয় না। স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন ও প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় গোপনে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ চলছেই।
রোহিঙ্গা শিবিরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তুলনামূলক অনেক বেশি। তারপর রোহিঙ্গা ও বাঙালিদের মধ্যে বিয়েশাদির কারণে এবং অবৈধ পথে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয়ও পেয়ে যাচ্ছে। এসব প্রবণতা রোধ করতে না পারলে একসময় কক্সবাজারের চারটি সংসদীয় আসনে নির্বাচনের ফল নির্ধারণে রোহিঙ্গারা অনুঘটকের ভূমিকায় চলে আসবে। আর তখন ভোটের রাজনীতির চক্করে সব দলের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা তোষণ শুরু হবে, যার কিছু লক্ষণ এখনই দেখা যাচ্ছে। সেই সুযোগে আরো রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারে চলে আসবে। তখন সমস্যা আরো জটিল হবে। তখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক গোষ্ঠী কক্সবাজারকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের ঘাঁটিতে রূপান্তর করবে। প্যান ইসলামিজমের উন্মাদনায় বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সম্পর্ক আরো অবনতি হবে। বাংলাদেশের ভূখণ্ডীয় নিরাপত্তার জন্য জটিল ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। কক্সবাজার বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক লোকেশন। সুতরাং সুদূরপ্রসারী দূরদৃষ্টি ও পরিকল্পনা না থাকলে সংকট মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পর তখন সেগুলো সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম মিলে বাংলাদেশে রেজিস্টার্ডসহ এখন পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা আছে। আরো পাঁচ লাখ এসে ১০ লাখ হলে কী হবে তা কি ভাবা যায়? সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঠিক নীতি ও সক্রিয় ভূমিকার কারণে ২০১২ সালে মিয়ানমার আগের মতো ব্যাপকসংখ্যক রোহিঙ্গা পুশ ইন করার চেষ্টা করে সফল হতে পারেনি। ভুল নীতির কারণে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশের ভেতরে রোহিঙ্গাদের ঠেলে দিয়ে সমস্যার সমাধান ব্যতিরেকে এর আরো বিস্তার ঘটিয়েছে এবং সমাধানের পথ কঠিন করে ফেলেছে। সুতরাং ১৯৭৮ ও ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গা পুশ ইনের ইস্যুকে বাংলাদেশের তত্কালীন সরকার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনার কারণে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা আজ এসে বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পাঠকের মতামত

কক্সবাজারে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র চালু, দৈনিক উৎপাদন ৩০ মেগাওয়াট

কক্সবাজার সদর উপজেলার বাঁকখালী নদীর খুরুশকুল উপকূলে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছেছবি: প্রথম আলো কক্সবাজার সদর উপজেলার ...

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে টার্গেট কিলিং!

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে চলছে ‘টার্গেট কিলিং’। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড ...

জান্নাতুলকে খুনের কথা আদালতে স্বীকার করলেন কক্সবাজারের রেজা

রাজধানীর পান্থপথে আবাসিক হোটেলে চিকিৎসক জান্নাতুল নাঈম সিদ্দিকা হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন ...